ক্রেতা সংকটে ভুগছে বরিশালের ভাসমান চালের বাজার
ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলা দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি। আর এখানে একসময় বণিক সম্প্রদায়ের বানিয়াতী ব্যবসাও ছিল।
ধারণা করা হয় বানীয়া শব্দ থেকে বানারীপাড়ার নামকরণ। তবে এর ভিন্ন যুক্তি থাকলেও অন্যতম ব্যবসাকেন্দ্র পরিচয়ের পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে এখানকার সন্ধ্যা নদীর ওপর ধান-চালের ভাসমান হাট।
যদিও সময়ের সাথে সাথে বানারীপাড়ার উপজেলার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া সন্ধ্যা নদীর পূর্ব পারের ভাসমান চালের বাজার এখন ক্রেতা সংকটে ভুগছে। আগের মতো জৌলুস না থাকায় বেচাবিক্রি কমে যাওয়ায় চারদিনের হাট দুইদিনে নেমে এসেছে। অনেকের মতে কালের বিবর্তনে কুটিয়ালদের চাল বিক্রির এ বাজার চিরতরে হারিয়ে যাবে।
প্রায় পাঁচ দশক ধরে এ হাটে বিভিন্ন ধরনের চাল বিক্রি করে আসা কুটিয়াল মো. হালিম বলেন, দিন যত যায় হাট তত ছোট হয়ে আসছে। আগে এ হাটে প্রচুর গাহেক (চালের ক্রেতা) ছিল। বরিশালের বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও গোপালগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, ঢাকা, নোয়াখালী, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ নানান জায়গা থেকে গাহেক আসতো। আর এখন তার ছিটে ফোটাও আসে না। যা আসে তাও বানারীপাড়া ও পার্শ্ববর্তী উজিরপুর, নেছারাবাদ উপজেলা ও ঝালকাঠির গাভা রামচন্দ্রপুর থেকে। ফলে এখন ব্যবসা বাণিজ্য নরমাল হয়ে গেছে, আগে গালায় (বর্ধিত সময়/দিন) যে চাল বিক্রি হতো এখন শনিবার আর মঙ্গলবারের হাটবারেও তা হয় না।
যদিও বেশিরভাগ কুটিয়ালদের দাবি সময়ের সাথে সাথে চালের আধুনিক মিল-কারখানা হওয়ায় এ বাজারে প্রতিনিয়ত বিরূপ প্রভাব পড়ছে। নিয়মিত ক্রেতাদের ভিন্ন মত রয়েছে। পবন কুমার মিস্ত্রী ভাসমান চালের বাজারের নিয়মিত ক্রেতা।
তিনি বলেন, মহামারি করোনা শুরু হওয়ার পর থেকেই গাহেক বা পাইকারের সংখ্যা কমেছে সন্ধ্যা নদীর পূর্ব পারের ভাসমান চালের বাজারে। অথচ বাজারের চালের থেকে এখানকার চাল শতগুণ ভালো এবং খেতে সুস্বাদু।
কয়েক যুগ ধরে ভাসমান এই বাজার থেকে নিয়মিত চাল কেনেন ষাটোর্ধ্ব মজিবর বালীও বলেন একই কথা। তিনি বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকে এ চালের বাজারের কথা শুনে আসছি। কত বছর বয়স তা জানি না, তবে শত বছরের ওপরে হবে। আমার ছোটবেলায় পূর্বপারের বিশাল এলাকাজুড়ে ৪ দিন এ হাট বসতো। আর এখন পার্টি (ক্রেতা) আসে না দেখে শুধু লঞ্চঘাটের পন্টুন ঘিরে সপ্তাহে দুই দিন শনিবার ও মঙ্গলবার শ’খানেক নৌকা ও ট্রলারের গলুই ভর্তি চাল নিয়ে এ হাট বসে। হাট ভালো গেলে ৪ থেকে ৫ হাজার মণ চাল বিক্রি হয় আর খারাপ গেলে তিন হাজার মণ চাল বিক্রি হয় এখন।
তবে পাইকাররা এগিয়ে আসলে এখনও এ হাটকে জমজমাট করে তোলা সম্ভব বলে জানিয়েছেন কুটিয়ালরা। নলশ্রী এলাকার মো. মতিউর রহমান বলেন, স্থানীয় কুটিয়ালদের সক্ষমতা রয়েছে চাহিদা অনুযায়ী হাটে চাল সংগ্রহ করার কিন্তু সেই চাল কিনে নিতে খুচরো গাহেক নয় পাইকারদের এগিয়ে আসতে হবে।
আর ভাসমান হাটের চাল বিক্রেতা ইয়ার হোসেন সু-দৃষ্টি কামনা করে বলেন, আমাদের অবস্থা আসলেই ভালো যাচ্ছে না। ক্রেতা না থাকলে হাট যেমন থাকবে না, তেমনি কুটিয়ালদেরও না খেয়ে মরার অবস্থা হবে।
ভাসমান চালের হাট ঘুরে জানা গেছে, প্রতি শনি ও মঙ্গলবার সকাল ৭ টা থেকে বেলা ১২ টা পর্যন্ত হাটের কার্যক্রম চলমান থাকে। এসময় বানারীপাড়া সদর, নলশ্রী, চাউলাকাঠি, নলশ্রী, খেজুরবাড়ি, ব্রাক্ষ্মনকাঠি এলাকা থেকে কুটিয়ালরা স্থানীয় প্রযুক্তিতে ধান সিদ্ধ করে বানানো চাল-এ হাটে নিয়ে আসেন। মোটা ও চিকন ধানের প্রকার ভেদে বর্তমান বাজারে মণপ্রতি চাল ২১ শত থেকে ২৮ শত টাকায় বিক্রি হয়।
এ হাটে সারাবছরে ইরি, আমন ও আইশ জাতের বিভিন্ন প্রকারের ধানের চাল পাওয়া যায়। বর্তমানে আমন মৌসুমের ধানের চাল বেচাবিক্রি চলছে। যেখানে মোটা ও চিকন মিলিয়ে কমলা মোটা, লাল মোটা, লাল চিকন, সাদা মোটা, মোথামোটা, দুধ কলম, নলভোগ, বাশফুল বালাম, কার্তিক বালাম, কাজলা, ভোজনসহ নানা ধরনের চাল পাওয়া যায়।